Friday, July 22, 2016

ঈদের চার ছবি নিয়ে লাখ টাকার প্রশ্ন!

দর্শক হলে ফিরেছে। ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলো নিয়ে চলছে আলোচনার ঝড়। সমালোচনার তীরও ছুটছে কিছু কিছু। যদিও সবকিছু ছাপিয়ে শাকিব খানই মুখ্য হয়ে উঠেছেন আলোচনায়। তবু তার বাইরেও থাকে অনেক কথা। গল্প, নির্মাণ ও বাদ বাকি আয়োজন নিয়ে সমালোচনা লিখেছেন রুম্মান রশীদ খান।
আজকাল আমরা সবাই সমালোচক। পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যনেল তো বটেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা একেকজন মহা বোদ্ধা। কিন্তু গঠনমূলক সমালোচনা আমরা ক’জন করতে পারি? শত্রুর ভালো আর মিত্রের খারাপটা আমরা ক’জন বলতে পারি? কেন জানি মনে হয়, আমরা সবকিছু চিন্তা করি ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে।
যখন টিকেট কেটেছিলাম, তখন তো আর ভাবিনি ছবিগুলো নিয়ে লিখতে হবে। তাই সমালোচকদের মত তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে পারবো না। সাধারণ দর্শক হিসেবে শুধু দু’কথা বলবো। বাংলা চলচ্চিত্রে সাম্প্রতিক সময়ের সবচাইতে সুসময় যাচ্ছে এখন। এই আনন্দের দিনে মন্দ কথাকে পাশ কাটিয়ে ভালোটাই বলতে চাই বেশি। তারপরও আমার কথায় কেউ কষ্ট পেলে, নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন।
শুরুতেই একটি ধাঁধাঁ। বলুন তো, এবারের ঈদে মুক্তি পাওয়া ৪টি ছবির মধ্যে শাকিব খান তো ৩টিতে অভিনয় করেছেন। তবে কোন অভিনেতা শাকিব খানকেও ছাড়িয়ে গেছেন? অর্থাৎ ৪টিতেই আছেন? উত্তর সহজ- সুব্রত। তবে চার ছবিতে অভিনয় করলেও ‘শিকারি’তে সুব্রত ছিলেন সবচেয়ে সপ্রতিভ। এবারের ঈদের সবচেয়ে দর্শকপ্রিয় ছবির নামও ‘শিকারি’; এ নিয়ে কারো কোনো সংশয় আছে বলে মনে হয় না। আমি দেখেছি মাল্টিপ্লেক্স থেকে একক প্রেক্ষাগৃহগুলোতে ‘শিকারি’র টিকিটের জন্য দীর্ঘদিন দর্শকদের হাহাকার। কারণ? ছবিতে শাকিব খানের নতুন লুক।
ছবির শুরুতে চেজিং দৃশ্যে শাকিবের অ্যাকশন দেখে দর্শকরা সগর্বে হাত তালি, শিস দিয়েছেন। শাকিব খান স্টাইল করে সিগারেট ফুঁকছেন, সেখানেও তালি। অ্যাকশন দৃশ্যে মারপিট শেষে মুখের রক্ত মুছছেন, সেখানেও তালি। কী চশমা, কী সানগ্লাস-সব লুকেই এ এক নতুন শাকিব খান।
যদিও এ ছবির পরিচালক কে, তা নিয়ে আজও আমি ধাঁধাঁর মধ্যে আছি! বাংলাদেশের জাকির হোসেন সীমান্ত আর ভারতের জয়দীপ মুখার্জি এ ছবির পরিচালক জানতাম, ট্রেলারে দেখেছি। যদিও পোস্টারে জয়দীপের নাম জয়দেব লেখা। সে যাই হোক, প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখলাম, ‘শিকারি’র পরিচালক বাংলাদেশের আব্দুল আজিজ এবং ভারতের রাজেশ কুমার! ঘটনা কি বুঝতে না বুঝতেই আবিষ্কার করলাম, ‘শিকারি’ সুরিয়া অভিনীত তামিল ছবি আধাভান-এর রিমেক। ৭ বছর আগে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। যদিও আধাভান-এর গল্পেও ছিল ১৯৯০ সালে মুক্তি পাওয়া মালয়ালাম ছবি হিজ ‘হাইনেস আব্দুল্লাহ’র ছায়া।
টালিগঞ্জের জিৎ প্রথমবারের মতো অভিনয় করেছেন ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘বাদশা’তে। ছবিতে জিৎ ‘পয়সা উসুল’ অভিনয় করেছেন। একজন সাধারণ দর্শক টিকেট কেটে যে ধরণের ছবি দেখতে চায়, বাদশা ঠিক সেরকম ছবি। এ গল্পে অ্যাকশন, রোমান্স, কমেডি, সেন্টিমেন্ট-সবই আছে। যদিও এ ক্ষেত্রে পুরো কৃতিত্ব গোপিচান্দ মালিনিনি’র। তারই লেখা ও পরিচালনায় ২০১০ সালে মুক্তি পাওয়া তেলেগু ছবি ‘ডন সিনু’র রিমেক বাদশা। ‘শিকারি’র মতো এ ছবির শুরুতেও ধাক্কা খেয়েছি। রাজেশ কুমার এবং আব্দুল আজিজ নাকি এ ছবিরও পরিচালক!
ছবির তিনটি গান নিয়েই ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রশ্ন/আক্ষেপ আছে। বাংলা ছবিতে ‘পিয়া তোরে বিনা জিয়া যায়ে না’ এ ধরণের হিন্দি কথা কিংবা ‘তোকে আমি আজ, করবো নিয়ে রাজ, রানী করে রাখবো তোকে রাজি হয়ে যা না!’-এ ধরণের ‘তুই তোকারি’ শুনতে ভালো লাগে না। তাছাড়া ‘ধ্যাত্তেরিকি’ গানের ব্যবহারও যথাযথ সময়ে হয়নি বলেই মনে হয়েছে।
ঈদের ছবিতে ঈদের গানের সংযুক্তি ছবিতে বাড়তি বিনোদন যোগ করেছে সন্দেহ নেই, তবে ‘ঈদ এসেছে’ গানের চিত্রধারণ পুরোটাই ‘তুমকো না ভুল পায়েঙ্গে’ এবং বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবির সালমান খানের গানের বাংলা সংস্করণ। এমনকি বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবির মত করে জিৎও কাছাকাছি রঙের কাবলি পরেছেন। দেখতে দৃষ্টিকটু লেগেছে।
আর নুসরাত ফারিয়াকে নিয়ে এটুকুই বলবো, নাচ এবং গ্ল্যামারের দিক দিয়ে পুরোপুরি ‘ফিল্মি’ হতে পেরেছেন তিনি। এ ছবিতে ফেরদৌস-ও আছেন। কৃত্রিম গোঁফটি না থাকলেই বরং ফেরদৌসকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হতো।
এ ছবিতে দেখলাম, বিমান বন্দরে বিনা বাধায় অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করা যায়! অ্যাকশন দৃশ্যে জিতের পিঠে লাগানো দড়িও চোখ এড়ায়নি। শুধু তাই নয়, তেলেগু ডন সিনু ছবির শট এনেও এ ছবিতে জোড়া লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। মূল ছবিতে মহেশ মঞ্জেরকারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের দৃশ্য ও প্রথম এন্ট্রি দৃশ্য কাট-কপি-পেস্ট হয়েছে।
‘শিকারি’ দেখার পর ‘সম্রাট’-এর শাকিব খানকে ব্যক্তিগতভাবে আমার ভালো লাগেনি। ভালো লাগার কথাও না। এখানে শাকিব খানের চরিত্রের কিংবা তার কস্টিউম/লুকের কোনো ধারাবাহিকতা ছিল না।
সম্রাট-এর ভালোটা আগে বলি। চন্দন রায় চৌধুরীর চিত্রগ্রহণ এ ছবিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। কালার গ্রেডিং, লোকেশন, শিল্প নির্দেশনা এক কথায় অসাধারণ! কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত কিংবা বিশেষ একটি হোটেল মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখেছি। বিশেষ করে থাইল্যান্ডে ‘রাতভর’ গানের চিত্রায়ন ছিল চমৎকার। অন্যদিকে অপু বিশ্বাসকে এ ছবিতে যতটা সুন্দরী লেগেছে, তা অন্য কোনো ছবিতে লেগেছে কিনা ভাবতে হবে।
কিছু দৃশ্যের অতি অভিনয় বাদ দিলে খল চরিত্রে মিশা সওদাগর সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। অর্থাৎ এ ছবিতে সুঅভিনয় শুধু মিশা সওদাগরই করতে পেরেছেন। বাকিরা পারেননি, কারণ তাদের চরিত্রই বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। অপু কেন বাগদত্ত ইন্দ্রনীলের কাছ থেকে ছুটতে চাইছেন- স্পষ্ট নয়! তিনি কেন শাকিবের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চাইছেন, শাকিবের সঙ্গে তার এমন কি হলো, যার কারণে বাগদান ভাঙতে চাইছেন? স্পষ্ট নয়!
এ ছবির গুটিকয়েক, হালকা চালের প্রেমের দৃশ্যগুলো সম্রাটের ইমেজকে দাঁড়াতে বারবার বাধা সৃষ্টি করেছে। শাকিবের সঙ্গে ডাক্তার অপু কেন মালয়েশিয়ার বারে নাচতে গেলেন, সে দৃশ্যে কোনো কথা না হবার পরও দেশে ফিরে হাসপাতালে শাকিব তাকে দেখেই কেন প্রেমে পড়ে বসলেন, স্পষ্ট নয়! ছবিতে বেশ ক’বার মিডল ফিঙ্গার পরিষ্কারভাবে দেখানোর পরও কেন এ ধরনের দৃশ্যে সেন্সরের কাঁচি চলেনি, বোধগম্য হলো না। শুধু তাই নয়, অশ্লীল ইঙ্গিত সহকারে মিশা সওদাগরের সংলাপ: ‘আমি হলাম রয়েল বেঙ্গল টাইগার, জায়গা মত ভইরা দিমু বিয়ার’! সেন্সর বোর্ডের সদস্যরা এ সংলাপ শুনেছেন কিনা, আর শুনলেও বুঝেছেন কিনা- প্রশ্ন রয়েই গেলো।
‘সম্রাট’ ছবির সবচাইতে মন্দ দিক, এ ছবির গল্প, চিত্রনাট্য এবং সংলাপ। হিন্দি ডন ছবিতে যেমন ‘ডন কো পাকাড়না মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন হ্যায়’-এ ধরনের সংলাপ বাংলায় অনুবাদ করে কেন বার বার ছবিতে ব্যবহার করতে হবে? শাকিবের ঠোঁটে সাজু খাদেমের কণ্ঠও যথেষ্ট বিরক্তির সৃষ্টি করেছে।
হয়তো শাকিব খান ডাবিংয়ের জন্য সময় বের করতে পারেননি, তাই বলে সাজু খাদেম অনুকরণ করতে পারেন বলে তাকে দিয়ে ডাবিং করাতে হবে? যদিও শাকিব নিজে যে দৃশ্যগুলোর ডাবিং করেছেন, সে দৃশ্যগুলোতেও বেশ কিছু দৃশ্যে ভুল উচ্চারণ করেছেন। সাম্রাজ্যকে বলেছেন সম্রাজ্য।
‘রানা পাগলা’ দেখার পর ভেবেছি, ছবিটি কি আমাকে বিনোদন দিতে পেরেছে? এ ছবির ভালো দিক কী? ভালো দিক অবশ্যই আছে-ছবির নির্মাতাদের সবকিছুতে একটা চমক দেয়ার চেষ্টা ছিল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। কাজের ক্ষেত্রে আবেগী ছিলেন তারা, এটি পর্দাতেও বোঝা গেছে। মিশা সওদাগর বিভিন্ন পত্রিকায় বলেছেন, তিনি ‘রানা পাগলা’ ছবির কাহিনি বোঝেননি। অনেক দর্শকও বলেছেন তারা এই সাইকো থ্রিলার ছবির মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝেননি।
দর্শকদের কাছে গল্পটি সহজবোধ্য করার জন্য পরিচালক আরেকটু যত্নশীল হতে পারতেন। ছবির শুরুতেই তিন-চারটি খুন করেন শাকিব খান। এ দৃশ্যগুলো আবার পরবর্তীতে দুই বার লম্বা সময় নিয়ে দেখানো হয়। কেন? সম্পাদক কি ভুলে গিয়েছিলেন, দর্শক এ দৃশ্যগুলো বেশ কয়েকবার দেখে ফেলেছেন? ছবিতে শাকিব খানের পাগলাটে হয়ে একের পর এক প্রতিশোধ নেবার দৃশ্যগুলো খুব একটা উত্তেজনা তৈরি করতে পারেনি।
‘রানা পাগলা’য় আঁচল-শাকিব খান কিংবা তিশা-শাকিব খানের প্রেম কাহিনিতে খুব একটা সময় দেয়া হয়নি। এ কাহিনি না ছিল টক, না ঝাল, না মিষ্টি। দর্শক কেন ‘রানা’ শাকিব খানের কষ্ট অনুভব করবেন? ছবির শুরুতে চমকের যোগান দিতে কণ্ঠ তারকা পড়শি হাজির। একটি গানেই শুধু তার উপস্থিতি, কিং খানের সঙ্গে। কিন্তু পড়শী কেন এলেন, কেনই বা গানের পর হাওয়া হয়ে গেলেন, লাখ টাকার প্রশ্ন।
তিশাকেও বা কেন এ চরিত্রে শাকিব খানের নায়িকা হিসেবে নির্বাচন করা হলো? তিনি মূলধারার বানিজ্যিক ছবিতে অভিনয় করতেই পারেন। শাকিব খানও তার নায়ক হতে পারেন। কিন্তু ‘সিমি’ চরিত্রের মাঝে তিশাকে তার মতো করে পাওয়া গেলো না।
Previous Post
Next Post

post written by:

0 comments: